কোটা সংস্কার আন্দোলনে আইন লঙ্ঘন করে প্রাণঘাতী অস্ত্রের নির্বিচার ব্যবহার
- by Ibrahim Akon
- August 28, 2024
- 77 views
ভিডিও ও ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করার ক্ষেত্রে শটগান, পিস্তল ও চাইনিজ রাইফেল—এই তিন শ্রেণির অস্ত্রের ব্যবহার বেশি হয়েছে। -ফাইল ছবি
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পার্কের মোড়ে মিছিল করার সময় পুলিশের বাধার মুখে পড়ে। মিছিলের সামনের সারিতে থাকা আবু সাঈদ দুই হাত প্রসারিত করে পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে যান। একা, নিরস্ত্র আবু সাঈদকে লক্ষ্য করে পুলিশ একের পর এক গুলি চালায়। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
শুধু রংপুর নয়, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমন করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। অন্তত তিন ধরনের প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে মানুষ হত্যার তথ্য পাওয়া গেছে। ১৬ জুলাই থেকে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরদিন পর্যন্ত ৭৫৮ জনের নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে, যাঁদের বেশিরভাগই প্রাণঘাতী অস্ত্রের গুলিতে নিহত হয়েছেন। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির মতে, ৭০ শতাংশ মৃত্যুই গুলিতে হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ক্রাইসিস এভিডেন্স ল্যাব রংপুরে আবু সাঈদের গুলিবিদ্ধ হওয়ার দুটি ভিডিও বিশ্লেষণ করেছে। সংস্থাটি জানিয়েছে, স্যাটেলাইট ছবি ব্যবহার করে দেখা গেছে, ১৫ মিটার দূর থেকে আবু সাঈদকে গুলি করা হয়। তিনি পুলিশের জন্য কোনো হুমকি ছিলেন না। ভিডিওতে গুলির ঘটনাকে ইচ্ছাকৃত বলেই মনে হয়েছে।
অন্যান্য ঘটনায়ও একই ধরনের চিত্র পাওয়া গেছে। বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আত্মরক্ষার পরিস্থিতি না থাকা সত্ত্বেও পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে ১৬ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত ৩৪১ জন নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১৭৫ জনের মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ১৩৭ জনের শরীরে প্রাণঘাতী গুলি এবং ২২ জনের শরীরে শটগানের গুলির চিহ্ন ছিল। অনেকে লক্ষ্যবস্তু করে গুলির শিকার হয়েছেন বলে জানা গেছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর, ৪ আগস্ট থেকে পরবর্তী সময়ে আরও ৪১৭ জন নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৪ আগস্ট এক দিনেই সারা দেশে ১১৬ জন নিহত হন। ওই দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও আন্দোলনকারীদের ওপর প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি চালায়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের হাতে শটগান, বন্দুক ও পিস্তল বেশি দেখা গেছে। কোথাও কোথাও রাইফেলও দেখা গেছে। ফেনীতে সংসদ সদস্য নিজাম হাজারীর অনুসারীরা একে-৪৭ ও এম-১৬ রাইফেল দিয়েও গুলি চালায়।
শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর ৫ আগস্ট বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী এবং পুলিশ স্টেশনগুলোতে হামলার ঘটনা ঘটে। এতে অনেক পুলিশ সদস্য নিহত হন। ৫ আগস্ট আক্রান্ত থানাগুলো থেকে পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি চালায় বলে জানা গেছে।
কিন্তু আন্দোলনকারীরা বলছেন, ৫ আগস্ট সকাল থেকেই বিভিন্ন স্থানে পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়েছে। সবচেয়ে বেশি গুলির ঘটনা ঘটেছে যাত্রাবাড়ীতে। এছাড়া ১৬ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত পুলিশ বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক গুলি চালিয়েছে।
মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলির বেআইনি ব্যবহার করা হয়েছে। এ ছাড়া, কাঁদানে গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড, এবং সাঁজোয়া যান ব্যবহার করে আন্দোলন দমন করা হয়েছে।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ বলেন, কোনো বিক্ষোভ বা জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে ধৈর্যের প্রয়োজন হয়, কাউকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে গুলি করা পুলিশের কাজ নয়। কিন্তু বর্তমান সময়ে পুলিশ পেশাদারিত্বের চেয়ে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা বেশি করছে।
এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “নিরস্ত্র মানুষের ওপর যত্রতত্র গুলি করা হয়েছে, যা খুবই ভয়ংকর ও অপেশাদার কাজ।”
জাতিসংঘের মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র অনুযায়ী, প্রত্যেকের জীবন, স্বাধীনতা এবং দৈহিক নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলন দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইন লঙ্ঘন করেছে এবং মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন ঘটিয়েছে।